এমন বন্ধুত্বও হয়!
‘হুক্কা হুয়া, কেয়া মজা, বনের রাজা কুপোকাত, কুয়োর মধ্যে দেখে ছায়া লম্ফ দিয়ে প্রাণপাত’। বনের রাজা সিংহকে বুদ্ধির জোরে হারিয়ে কুয়োয় ফেলে এভাবে উল্লাস করেছিল শেয়াল পণ্ডিত।
শৈশবে পড়া পঞ্চতন্ত্রের এ গল্প অনেকেরই মনে আছে নিশ্চয়ই। তবে এবার সিংহ কুপোকাতের কোনো গল্প আর নয়, একদম বন্ধুত্বের বন্ধনের। সিংহের সঙ্গে রক্ত মাংসের মানুষের বন্ধুত্ব।
পৃথিবীর অন্যতম হিংস্র শিকারি প্রাণী সিংহ। শক্ত চোয়াল দিয়ে সে সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে খেতে পারে। বনের সব প্রাণী তার ভয়ে অস্থির ও তটস্থ থাকে। তবে সিংহ শাবক জিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে এসব কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি ফিরিক্কি ভন সলমসের (৬৯) সামনে।
জিয়ন এখন অনেকটা বড় হয়েছে। শরীরের ওজন দুইশ’ চুয়ান্ন কেজিরও বেশি। জিয়ন ও ভন এখন একই বিছানায় শোয়, দৌড়াদৌড়িও করে একসঙ্গে। একজন অন্যকে ছেড়ে এক মুহূর্ত থাকতে পারবে, এমনটা ভাবাও অসম্ভব।
সিংহ শাবকটিকে এগারো বছর ধরে পেলেপুষে বড় করে তুলেছেন ভন সলমস। চিড়িয়াখানায় সিমবা নামের এক সিংহীর গর্ভে জন্মেছে জিয়ন। কিন্তু জিয়নের বাবা হত্যা করে খেয়ে ফেলতে পারে এই ভয়ে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে। আদর-যত্ন করে বড় করতে রাখা হয় ভন সলমসের কাছে। পরবর্তী কাহিনী রূপকথার গল্পের মতোই।
জিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে ভন সলমসের। তারা এখন একে অপরের অন্তরাত্মা। জিয়ন কোলাহল অপছন্দ করে, ভনও তার অসুবিধার কথা ভেবে নগ্ন পায়ে হাঁটে। বন্ধুত্ব যখন হয়ে গেছে, তখন বন্ধুকে খুশি রাখতে এতটুকু কষ্ট সয়ে নিতে হয়।
শাবকটিকে এখন বনে ফেরত পাঠানোও কঠিন। কারণ সে ভনের কাছে পোষ মেনেছে। এটাকে এখন তার বেড়ে ওঠার প্রাকৃতিক পরিবেশ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশের ‘শীতরাত’ কবিতার ‘সিংহ অরণ্যকে পাবে না আর’ বাক্যটি পরিবর্তন করে বলা যায় ‘সিংহ অরণ্যকে যাবে না আর, যাবে না আর, যাবে না’।
ভন সলমসের তত্ত্বাবধানে চিতাসহ আরও আঠারোটি সিংহ রয়েছে। তবে গেল এগারো বছরে জিয়নের সঙ্গেই তার বন্ধুত্বের বন্ধন জোরালো ও সবচেয়ে মজবুত। দেখা যায়, অবিরত ট্রাক চলায় ধুলোবালির রাস্তায় জিয়নের লেজ ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছে ভন সলমস। বুকে, পিঠে হাত বুলিয়ে জিয়নকে আদর করছে ভন, চুমো খাচ্ছে মুখে, ঘাড়ে।
নিজের বাড়ির ঠিকানা গোপন রেখে ভন সলমস বলেন, জিয়নকে তত্ত্বাবধানে নেওয়ার পরে আমি আরও উনিশটি চিতা বড় করেছি। কিন্তু সে খুব বিশেষ ধরনের। সবার থেকে আলাদা। অন্যগুলোর সঙ্গে জিয়নের তুলনা চলে না। আমি তার কাছ থেকে অনেককিছু শিখছি।
তিনি বলেন, সিংহের সঙ্গে থাকা, খাওয়া ও প্রাণীটিকে বড় করে তোলার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই একবারই ঘটেছে। জিয়ন খুব ভদ্র সিংহ, সে কখনো মানুষের ওপর চড়াও হয় না। আমি তার ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখি।
মোষের মতো পোষ মানা সিংহ শাবক জিয়নকে চার ঘণ্টা অন্তর অন্তর খাবার দিতে হয়। ভন তাকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেন ও তার সাথে খেলা করে সময় কাটান। ভনের জীবনে এভাবেই রূপকথার বাস্তব হয়ে ওঠে।