৪৯ হাজার ১৩ কোটি ডলার পাচার

Rate this item
(2 votes)
বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে পাচার হয়েছে ৪৯ হাজার ১৩ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ৩৮ লাখ কোটি টাকা। ভারতসহ বিশ্বের ৩৭টি দেশ পাচার হওয়া বাংলাদেশের এ অর্থ ভোগ করছে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে আছে আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, ব্রিটেন, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, রোমানিয়া, তুরস্ক, বেলারুশ, মরিশাস প্রভৃতি।

৬ মে ভারতীয় বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদক অমিত বসুর প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ভোগ করছে ভারত, আমেরিকাও’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। আয়ের ৮০ শতাংশ নানা পথে বিদেশে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় অংশের অধিকারী পোশাকশিল্প-সংশ্লিষ্টরাই মূলত পাচারের সঙ্গে জড়িত।

আমদানি শুল্ক না থাকায় কম দামে যন্ত্রপাতি ও মাল কিনে বেশি দাম দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হচ্ছে হরহামেশাই। প্রতিবেশী দেশের গণমাধ্যমে এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া আর্থিক খাতের লুটপাটের পুরোটাই পাচার হচ্ছে। সঙ্গে যাচ্ছে বিপুলসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতা, বড় মাপের প্রতারক ও টাউটদের টাকা।

জাতীয় পর্যায়ে লাখো মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেও লক্ষাধিক কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। আর শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের নানা কারণে অপ্রদর্শিত থেকে যাওয়া টাকা দেশে বিনিয়োগের সুযোগ না থাকায় অবধারিতভাবেই চলে যাচ্ছে বিদেশে। ইতিমধ্যে আর্থিক খাতের লুটেরা চক্রের সদস্যরা বিপুল অর্থ নিয়ে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে গড়ে তুলেছেন সেকেন্ড হোম। অনেকেই ইউরোপের দেশে দেশে নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানেই ফেঁদে বসেছেন শত শত কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য।

কেউ কেউ অন্য দেশে ব্যাংক পর্যন্ত খুলে বসেছেন। আবার টাকা পাচারকেই ব্যবসা হিসেবে নেওয়া সিন্ডিকেটগুলো এলসি, ওভার-আন্ডার ইনভয়েস, হুন্ডির পাশাপাশি চেইন শপ বা চেইন রেস্টুরেন্টের মতো স্থায়ী পদ্ধতিও খুলে অর্থ পাচার করছে। জানা যায়, ভিনদেশি প্রতারকদের সঙ্গে মিলেমিশে এ-দেশীয় সহযোগীরা দফায় দফায় নানা কায়দা-কৌশলে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আরেক চক্র সীমাহীন প্রতারণার বেড়াজাল তৈরি করে লুটে নিচ্ছে ব্যাংকগুলোর অর্থ।

একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী লাগামহীন দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ লুটপাট করেই ক্ষান্ত হননি, সেসব টাকা নিয়ে তারা পাড়ি জমিয়েছেন ভিন্ন দেশে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি আমলা—সব পেশার মানুষই টাকা পাচার করেছেন বিদেশে। অতিসম্প্রতি সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়া একজন সচিবের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়াসহ তিনটি দেশে ১৮০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। দুদকের চলমান অনুসন্ধানে ইতিমধ্যে ৮০০ কোটি টাকা পাচারের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। আবার ভুয়া এনজিও, এমএলএম ও ভুঁইফোড় হায় হায় কোম্পানিগুলো গত এক দশকে আড়াই লাখ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে।

প্রতারণার শিকার হয়েছেন কমবেশি চার কোটি গ্রাহক। প্রায় ৭০ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে কমপক্ষে ৫০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনি বা তিন লাখ গ্রাহকের ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া যুবকসহ ইউনিপেটুইউ, নিউওয়ের মতো জাতীয় পর্যায়ের টাউটরাও কোনো টাকা ফেরত দেয়নি। এগুলোর বড় অংশই চলে গেছে পাচারের আওতায়। সাধারণ মানুষের আমানত লুট করে ১২২টি হায় হায় কোম্পানি উধাও হলেও প্রায় অভিন্ন স্টাইলে বছরের পর বছর ধরেই চলছে এমএলএম লুটের দৌরাত্ম্য। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া আরেকটি বড় অংশ গেছে শেয়ারবাজার থেকে। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালের ধসের প্রক্রিয়ায় গেছে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা।

আর সর্বশেষ ধসে কমপক্ষে ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা লুট করে পাঠানো হয়েছে বিদেশে। অন্যদিকে একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানি অবৈধভাবে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা নরওয়েতে পাচার করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানে নেমেছে। অবৈধ ভিওআইপি বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতিবছর বিভিন্ন চক্র অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। বিদেশিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ভিওআইপি চক্র পাচার করছে অর্থ। সে হিসেবে সংঘবদ্ধ ভিওআইপি চক্রই হাতিয়ে নিয়েছে দুই লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। দেশে গজিয়ে ওঠা ৩৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ফিবছর দেদারসে পাচার হচ্ছে টাকা। বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা রেন্টাল, কুইক-রেন্টালের মতো ভর্তুকির নামে সরকারি কোষাগার থেকে লোপাট হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নেওয়া প্রায় এক লাখ কোটি টাকা হয়েছে পাচার।

সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি এবং বেসিক ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি ব্যাংকিং খাতে লুটপাটের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে রূপালী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি, জনতা ব্যাংকের চার হাজার কোটি, কৃষি ব্যাংকের আড়াই হাজার কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের তিন হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে লুটপাট হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা করে আত্মসাতের ডজনখানেক ঘটনা ইতিমধ্যে প্রকাশিত। দেশের হলমার্ক-বিসমিল্লাহর মতো তিনটি ব্যবসায়ী গ্রুপই লুটে নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ১২ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। এর বাইরে চট্টগ্রামের বহুল পরিচিতি দুটি শিল্পগ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যাংক থেকে লুটে ৩৭ হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ আছে।

এর একটি গ্রুপ সরকারি-বেসরকারি ছয়টি ব্যাংক মিলিয়ে শুধু ইনল্যান্ড বিল পার্চেজ (আইবিপি) করেই ১৭ হাজার কোটি টাকা কুক্ষিগত করেছে। এ অর্থ পাচার হয়েছে ইউরোপে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআরসহ অন্যান্য বিশ্লেষণে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসা, লেখাপড়াসহ আন্তদেশীয় নানা কর্মকাণ্ডে টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে হুন্ডিকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে। বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা শুধু হুন্ডির মাধ্যমেই পাচার হচ্ছে। সে হিসেবে গত ১০ বছরে দুই লাখ কোটি টাকা কেবল হুন্ডির মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে গেছে। প্রতিবেশী দেশের প্রভাবশালী হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সিন্ডিকেটের সঙ্গে শতাধিক হুন্ডি সিন্ডিকেট বিমান ও স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিবছর গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে। আর এ অবৈধ কাজে সহযোগিতা করছেন বেশ কিছু বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, মানি এক্সচেঞ্জ, কুরিয়ার সার্ভিস, বিমান ও স্থলবন্দর-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। তবে বড় অঙ্কের পাচারগুলোর ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে এলসি বাণিজ্যের অভিনব পদ্ধতি। সরাসরি ব্যাংকঋণ না নিয়ে এলসি বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে।

ব্যাক টু ব্যাক, মেশিনারিজ আমদানির এলসি অ্যাকাউন্ট খুলে এ জালিয়াতি করা হচ্ছে। পণ্য আমদানি না করে কাগজ দেখিয়ে বিদেশি ব্যাংকের কাছে স্থানীয় ব্যাংকের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করে দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের ওপেন সিক্রেট এ প্রতারণায় ১০ বছরে সরকারি-বেসরকারি ১১টি ব্যাংকের প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ আছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা ও কৃষি ব্যাংকেরই সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে এই এলসি প্রতারণায়।
0 awesome comments!
Scroll to Top