বাংলাদেশে ৩ মাসে কোটিপতি হয়েছেন ২ হাজার ২৫২জন
ব্যাংকিং খাতে ৩ মাসে কোটিপতি আমানতকারী বেড়েছে ২ হাজার ২৫২ জন। এর মধ্যে ৩৭ ব্যক্তি অর্ধশত কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন। এদের বেশিরভাগই শত কোটি টাকার মালিক। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তারা এই পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে আমানত রাখেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তৈরি করা এক প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক হিসাবে ৫০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তি ছিলেন ৫৫৮ জন। বর্তমানে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯৫ জনে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তিন মাসের ব্যবধানে নতুন করে ৪০ কোটিরও বেশি পরিমাণ টাকার মালিক হয়েছেন ৩৫ জন।
সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক হিসাবে ৪০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তি ছিলেন ১৮৫ জন। বর্তমানে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২০ জনে। একইভাবে গেল তিন মাসে ব্যাংক খাতে নতুন কোটি টাকা আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ২ হাজার ২৫২ জন।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা আইটিকে বলেন, ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বৃদ্ধিকে পজিটিভভাবে দেখতে হবে। কারণ, এই পরিমাণ টাকা দেশ থেকে পাচার না হয়ে ব্যাংকে প্রবেশ করেছে। এটা একটা ভালো দিক। তবে ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারী বাড়ার ফলে একটি বিশেষ শ্রেণি ধীরে ধীরে ধনী হয়ে যাচ্ছে। এতে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর শেষে ১ কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন ৪৭ হাজার ২৭৭ জন। তিন মাস আগে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে ১ কোটি টাকার ওপরে আমানত রাখা ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজার ২৫ জন।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর শেষে ৪০ কোটি টাকার ওপরে রয়েছে ২২০ জন। ৩৫ কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন ১৬৬ জন। ৩০ কোটি টাকার ওপরে রেখেছেন ২০৭ জন। ২৫ কোটি টাকার ওপরে রয়েছে এমন আমানতকারীর সংখ্যা ৩৭৭ জন। ২০ কোটি টাকার ওপরে রয়েছে ৬২৯ জন গ্রাহকের। ১৫ কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে ১ হাজার ৫৫ জনের। ১০ কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন ২ হাজার ১০৮ জন। ৫ কোটি টাকার বেশি আমানতকারী রয়েছেন ৭ হাজার ৬৫ জন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলা আইটিকে বলেন, বৈষম্যমূলক হলেও অনেকের আয় বাড়ছে। কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ার এটাই প্রমাণ করে। তিনি বলেন, বিনিয়োগ পরিবেশ এখন স্থবির, আবার শেয়ার বাজারের অবস্থাও ভালো নেই। এই দু’টি কারণে অনেকে ব্যাংক টাকা রাখতে পছন্দ করছেন। তিনি বলেন, বিনিয়োগে না যাওয়ার কারণে ব্যাংকে টাকা ঢুকছে। এক্ষেত্রে কালো টাকা সঞ্চিত রাখার একটা বড় নিরাপদ স্থান হচ্ছে এফডিআর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকে কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন ১০ হাজার ৬৪০ জন। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে ১ হাজার ৩৩২ জন। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রয়েছেন ৩২ হাজার ৫১০ জন। বিদেশি ব্যাংকগুলোয় কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন ২ হাজার ৭৯৫ জন।
জানা গেছে, তিন মাসে ২ হাজার ২৫২ জন নতুন করে কোটিপতি হলেও ক্ষুদ্র আমানতকারীদের একটি অংশ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে সঞ্চয়পত্র বা অন্যত্র বিনিয়োগ করেছেন। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে সংসার খরচও মেটাচ্ছেন। পাশাপাশি উচ্চ সুদসহ নানা কারণে শিল্পোদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এ অবস্থার মধ্যেও বাড়ছে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ব্যাংকে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বাড়লেও কোটিপতিদের একটি বড় অংশ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন। যা দেশের রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, একদিকে ক্ষুদ্র আমানতকারী ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন, অন্যদিকে কোটিপতি আমানতকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এটা এক ধরনের বৈষম্য। একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষজন ব্যবসা-বাণিজ্য করার কারণে অন্যরা পিছিয়ে পড়ছেন। ফলে সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে সম্পদ ক্রমেই কিছুসংখ্যক লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে।
কোটিপতির সংখ্যা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, পঁচাত্তরের পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে জনগণের সঞ্চয় এবং বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য কতিপয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণের জন্য ব্যাংকের দরজা খুলে দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় আশি ও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা উঠে আসেন কোটিপতির তালিকায়। নব্বইয়ের দশকে জমি কেনা-বেচা, হাউজিং ও গার্মেন্ট ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী, নির্মাণ কাজের ঠিকাদারদের নিয়ে কোটিপতির তালিকায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এছাড়া সম্প্রতি পেশাজীবীদের মধ্যে উকিল ও ডাক্তারদের অনেকে কোটিপতির তালিকায় রয়েছেন। এর বাইরে সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে টোকাই থেকে কোটিপতি হয়েছেন এমন উদাহরণও রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটিপতিদের দখলে রয়েছে ৬৮ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ জনে।
জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে (ডিসেম্বর ১৯৮০) এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৮ জনে। তখন তাদের আমানতের পরিমাণ ছিল ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ১০ শতাংশ।
এরশাদ সরকারের পতনের সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৩ জন ও আমানতের পরিমাণ ১২ শতাংশ। এ ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতির মোট সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৯৪ জন ও আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ২০ শতাংশ।
২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২ জন। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ২ বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (২০০৭-০৮) ৫ হাজার ১১৪ জন। এরও আগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (অক্টোবর ২০০১-ডিসেম্বর ২০০৬) কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮৮৭ জনে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকার ওপরে হিসাব সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ১৩০টি। ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৫৩৭টি। ২০১১ সালের ডিসেম্বর শেষে এক কোটি টাকা লেনদেনের হিসাবের সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজার ৬৯৮টি। পরের বছর ব্যাংকগুলোতে এক কোটির ওপরে থাকা হিসাব সংখ্যা ছিল ৪৩ হাজার ৭১২টি।