পুরুষ যখন ঘরোয়া নির্যাতনের শিকার !
নির্যাতন কথাটি শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে একটি অবলা নারীর উপর শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের ছবি। কারণ আমাদের মনের ভেতর যে বিষয়টি গেঁথে গিয়েছে তা হলো, যেকোনো ধরণের নির্যাতনের শিকার শুধুমাত্র নারীরাই হবে। কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেছেন, ঘটনাটি যদি উল্টো হয় তখন ব্যাপারটি কি দাঁড়ায়? নির্যাতন যদি পুরুষের ওপর হয়?
শুধু নারীরাই নন, পুরুষেরাও নির্যাতিত হন ঘরে এমনকি বাইরেও। নারী নির্যাতনের ঘটনা যেমন প্রতিনিয়ত ঘটছে, ঠিক তেমনি পুরুষ নির্যাতনের মাত্রাও বেড়ে চলেছে। নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো আমাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে মিডিয়ার ব্যাপক প্রচারে, অন্যদিকে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাগুলো কিন্তু আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে। আড়ালে থাকলেও পুরুষ নির্যাতনের ঘটনা কিন্তু কম ঘটছে না। বরং দিন দিন বেড়েই চলছে।
যেভাবে নির্যাতিত হন পুরুষেরা
পারিবারিকভাবে পুরুষেরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন। এই নির্যাতন হতে পারে শারীরিক কিংবা মানসিক। আসুন দেখে নিই কিভাবে ও কাদের দ্বারা পুরুষেরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছেন।
১. নিজের স্ত্রী দ্বারা
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, অনেক নারী আছেন এই সমাজে যাদের দ্বারা পুরুষেরা নির্যাতিত হন। প্রশ্ন জাগতে পারে একজন নারী থেকে পুরুষের শক্তি বেশি তাহলে কিভাবে এই পুরুষেরা নির্যাতিত হচ্ছেন। হ্যাঁ, নারীরা শারীরিক দিক হতে পুরুষের থেকে দুর্বল কিন্তু নির্যাতন করা মানে এই নয় যে একজন নারী তার স্বামীকে শুধুমাত্র শারীরিকভাবে আঘাত করছেন। নির্যাতনটি মানসিকভাবেও করতে পারেন। অনেক নারীই আছেন যারা তার স্বামীকে নানানভাবে মানসিক নির্যাতন করে থাকেন। সংসারে প্রতিদিন কলহ করা, অযথা দোষারোপ করা কিংবা অর্থের জন্য প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন করাও এক প্রকার মানসিক নির্যাতন যা অনেক মহিলারাই করে থাকেন। এছাড়া স্বামীকে বাবা মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলা ও সন্তানদের থেকে দূরে রাখাও কিন্তু নির্যাতন। মানসিকভাবে এভাবে নির্যাতিত হওয়ার পাশাপাশি অনেক পুরুষ শারীরিকভাবেও নির্যাতিত হচ্ছেন। অনেক পুরুষই আছেন যারা তাদের স্ত্রীর দ্বারা শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন। এছাড়াও অনেক নারীই আছেন যারা অন্য যেকারো সহযোগিতায় নির্যাতন করতে পারেন। স্ত্রীটি অন্য পুরুষ যেমন- বাবা, ভাই, বন্ধু কিংবা ভাড়া করা কাউকে দিয়েও স্বামীর উপর শারীরিক নির্যাতন চালাতে পারেন।
২. বাবা মায়ের দ্বারা
আমাদের সমাজটি এমন যে এখানে পুরুষদের দেখা হয় অর্থ উপার্জনের যন্ত্র হিসেবে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশে মেয়ে সন্তানের চেয়ে ছেলে সন্তান কাম্য অনেকাংশে এই কারনেই। মেয়ে হলে বিয়ে করে চলে যাবে কিন্তু ছেলে সংসারের হাল ধরবে এই চিন্তা এখনও অনেকেই করেন। এইজন্য পুরুষদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় অনেক কিছুই কিশোরকাল থেকেই। দেখা গেলো একই পরিবারের মেয়েটি তার পছন্দের চারুকলা বিষয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে কিন্তু পছন্দের বিষয় হওয়া সত্ত্বেও ছেলেটি সেটা পারছে না। কারণ তার বাবা মা দিচ্ছেন না। চারুকলায় পরে বেশি অর্থ উপার্জন সম্ভব নয় এটিই মূল কারণ। এটিও একধরনের মানসিক নির্যাতন। এছাড়া আরও একটি নির্যাতন বাবা মায়েরা করে থাকেন তা হল বিয়ের ব্যাপারে। জোর করে শুধুমাত্র মেয়েদেরই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় না। ছেলেদেরও এই নির্যাতন সহ্য করতে হয়। অনেক সময় নিজের মত না থাকলেও বাবা মায়ের চাপে পরে বিয়ে করতে হয় অনেককে।
৩. বন্ধুদের দ্বারা
পুরুষেরা ঘরে নির্যাতনের পাশাপাশি বাইরেও নির্যাতিত হন নিজের বন্ধুদের দ্বারাই। পারিবারিক পর্যায়, চেহারা, উচ্চতা, চাকরির বেতন ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়ে হাসির ছলেই অনেকে খোঁচা দিয়ে কথা কথা বলেন। সব সময় কিছু না কিছু নিয়ে ছেলেরাই ছেলেদের হেয় প্রতিপন্ন করে যাচ্ছে। নারীদের মধ্যে এই ধরণের প্রবনতা কম দেখা যায়। মেয়েরা নিজের বান্ধবীর কোন খুঁত কিংবা তার বেতন নিয়ে কোন ধরণের কটু করা কথা না বললেও অনেক ছেলেই তার বন্ধুর খুঁত নিয়ে খোঁচা সূচক কথা বলে মজা পান। কিন্তু এইধরনের কথা বার্তা ও আচরণও মানসিক নির্যাতনের মধ্যে পরে।
পুরুষ নির্যাতন যে কারনে আড়ালে পরে যায়
পুরুষ নির্যাতনের সমস্যাটি এত গুরুতর হওয়ার প্রধান কারন হচ্ছে এই সব নির্যাতিত পুরুষেরা ন্যায় বিচার পাচ্ছেন না। নানা কারনে প্রতিদিন চুপচাপ নির্যাতন মেনে নিচ্ছেন অনেকেই। দেখে নিন কেন পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাগুলো আড়ালে পরে যায়।
১.লোক লজ্জার ভয়
একজন পুরুষ নারী দ্বারা শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন এই ঘটনা কোন পুরুষ নিজে মুখে বলতে লজ্জাবোধ করেন আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কারনে। সেজন্য পুরুষেরা ভাবেন নারী দ্বারা শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন এটি প্রকাশ পাওয়া তার জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। শুধুমাত্র এই কারনে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়। একজন পুরুষ যখন একটি নারীর ওপর নির্যাতন চালিয়ে সেটা জাহির করে তখন কেও তাকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ না করলেও যে পুরুষটির ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে তাকে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে কেও ছাড়ে না। গত বছর ভারতের একটি প্রদেশে বেঙ্গালুরুর মনোজ কুমার নামে একজন ভদ্রলোক পুলিশের কাছে মামলা দায়ের করতে আসেন তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে। তিনি পুলিশকে জানান তার স্ত্রী তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। তখন দায়িত্বরত পুলিশ মামলা নিতে শুধুমাত্র অস্বীকৃতি জানানো নয় তাকে নিয়ে উপস্থিত সকলের সামনে ঠাট্টা বিদ্রূপ করেন। আমাদের সমাজ নির্যাতিত নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও নির্যাতিত পুরুষের দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে। কোনভাবে নির্যাতনের ঘটনা বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় সজনদের কাছে প্রকাশ পেলে সহানুভূতির পরিবর্তে ঠাট্টা বিদ্রূপও নির্যাতিত পুরুষদের সহ্য করতে হয়।
২. পারিবারিক সহযোগিতার অভাবে
পরিবারের মুরুব্বীদের সহযোগিতার অভাবে পুরুষেরা চুপচাপ অনেক কিছুই মেনে নেন। নিজের ইচ্ছা ও শখ বিসর্জন দিয়ে না চাইলেও অনেক কিছু মেনে নেন অনেকে। দুঃখের ব্যাপার হল এই যে পারিবারিক এই নির্যাতন কাওকে বলাও যায় না। আড়ালেই রয়ে যায়।
৩. মিথ্যা মামলা ও সন্তান হারানোর ভয়ে
অনেকে পুরুষই নিজের স্ত্রীর দ্বারা নির্যাতন সহ্য করে নেন মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে যাওয়ার ভয়ে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে যদি কেও তার স্ত্রীর সাথে সম্পর্কছেদ করতে চান সেক্ষেত্রে অন্যভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয় পুরুষদেরকে। একজন নারী যখন তার স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলা দায়ের করেন এবং সম্পর্কছেদ করতে চান তখন নিয়ম অনুযায়ী সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু একজন পুরুষ তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে চাইলে মামলা নেয়া হয় না। যদি সম্পর্কছেদ করতে চান তবে উল্টো মামলায় জড়িয়ে যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। অনেক সময় নির্যাতিত স্বামী স্ত্রীর সাথে সম্পর্কছেদ করতে চাইলে স্ত্রী তার বিরুদ্ধে মিথ্যা নির্যাতনের মামলা দায়ের করে বিবাহবিচ্ছেদের টাকা দাবি করেন। এমনকি মিথ্যা মামলা দায়ের করে সন্তানের কাছ থেকেও বিচ্ছেদের মত ঘটনার নজির রয়েছে।
পুরুষ নির্যাতনে করণীয়
১. নারী নির্যাতন আইনে সুনির্দিষ্ট শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু পুরুষ নির্যাতনের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোন নীতিমালা নেই। নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার আছে পুরুষেরও। সুতরাং পুরুষ নির্যাতনের জন্য আইন প্রনয়ন করতে হবে।
২. পারিবারিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরী। বাবা মাকে তার ছেলের মন মানসিকতা বুঝতে হবে। তাদের বুঝতে হবে তার ছেলে কোন অর্থ উপার্জনের যন্ত্র নয়। সে মানুষ। তার সিদ্ধান্ত তাকে নিতে দিন।
৩. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। নারী নির্যাতন হলে যেমন ভাবে তা একটি অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, পুরুষ নির্যাতনের ক্ষেত্রেও তা হতে হবে। যাতে করে নির্যাতিত হয়ে কেউ চুপচাপ মেনে না নিয়ে এ ব্যাপারে সবার সাথে কথা বলে সমস্যা সমাধান করতে পারেন পুরুষেরা।